জাতীয়

ভুরুঙ্গামারীর বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নে অনলাইন জন্মনিবন্ধনে ব্যাপক গড়মিল

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামে এক উপজেলার নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধনের কোড ব্যবহার করে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আরেক উপজেলায়। ফলে জন্মনিবন্ধন ফরম ব্যবহার করতে না পেরে চরম বিপাকে পড়েছে এসব নাগরিক। অনুসন্ধানে দেখা যায় কুড়িগ্রাম জেলায় অনলাইন জন্ম নিবন্ধনে ৭৬ জন নাগরিকের তথ্য ভুল করা হয়েছে। ৫/৬বছর ধরে ভুলের কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে এসব সাধারণ নাগরিকদের। এছাড়াও অনলাইনে একাধিক ব্যক্তির দুটি করে জন্ম সনদসহ অন্য জেলা এবং উপজেলার অধিবাসীদের তথ্য লিপিবদ্ধ করায় ভোগন্তিতে পড়েছে প্রকৃত জন্মসনদধারীরা। উল্টো অভিযোগ করে বিপাকে পড়েছে এক ইউপি সচিব। তবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস প্রশাসনের।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কুড়িগ্রামে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়ন পরিষদে ২০১৫ হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৭৬ জন নাগরিকের জন্ম সনদের প্রকৃত তথ্যের ভুল বের হয়েছে। ইতোপূর্বে নেয়া এসব জন্ম সনদে এখন আর মিলছে না পূর্বের নাগরিকদের সঠিক তথ্য। তাদের নাম, ঠিকানার পরিবর্তে পার্শ্ববর্তী রাজারহাট উপজেলার ছিনাই এবং সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এবং লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলার নাগরিকদের তথ্য উঠে আসছে অনলাইনে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের কাছে জন্ম নিবন্ধন সনদ রয়েছে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়ন পরিষদের কোড নম্বর। কিছু জন্ম সনদে রয়েছে নাম ও ঠিকানা ভুল। ভিন্ন উপজেলার কোড এবং নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দাকে দেয়া হয়েছে জন্ম সনদ। এছাড়াও বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নে একাধিক ব্যক্তির নামে রয়েছে দুটি করে জন্ম সনদ। অনলাইনে লিপিবদ্ধ ৭৬ জন নাগরিকের নাম, পিতা-মাতা, জন্ম তারিখ, ঠিকানা ঠিক রেখে জন্ম নিবন্ধন নম্বর, নিবন্ধনের তারিখ এবং সনদ ইস্যুর তারিখ পরিবর্তন করে রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দার তথ্য লিপিবদ্ধ করে দেখানো হয়েছে অনলাইনে। রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নে এসব নাগরিকগণ নিজেরাও জানেন না তাদের তথ্য ভূরুঙ্গামারীর বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ফলে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় শংকিত এসব বাসিন্দারা। অনেকেই জন্ম সনদ উত্তোলন না করেও জন্ম সনদে নিজের তথ্য দেখে অবাক হচ্ছেন। দিনের পর দিন অনলাইনে এমন ঘটনা ঘটলেও খোঁজ রাখেনি কর্তৃপক্ষ।
রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দা নাছিমা খাতুনের পিতা নওশাদ আলী জানান, আমার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ ছিনাই ইউনিয়ন হতে তুলেছি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি রাজারহাটে ২০১৯ সালে জন্ম নিবন্ধন করা হলেও ২০১৭ সালের ডাটায় ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নে আমার মেয়ের নাম-ঠিকানাসহ আরেকটি জন্মনিবন্ধন ডাটা হয়েছে। কিভাবে এমনটি ঘটলো আমি জানিনা। আমি বা আমার পরিবারের কেউ কখনো ভূরুঙ্গামারী যাইনি।
নাছিমা খাতুনের মা আলতা বেগম জানান, মেয়ের বিয়ের সময় জন্ম নিবন্ধন ছিনাই ইউনিয়ন থেকে নেয়া হয়েছে। আমরা এই ইউনিয়নের বাসিন্দা। ছিনাইয়ের ঠিকানা কিভাবে ভুরুঙ্গামারীতে গেল তা নিয়ে বিস্মিত তিনি। একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী রাহেনা বেগমেরও। তিনি জানান, আমার মেয়ে শিরিনা ও ছেলে আনোয়ারুলের জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়েছি ছিনাই ইউনিয়ন থেকে। কিভাবে তাদের ঠিকানা ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় গেছে তা নিয়ে শংকিত তারা। ছিনাই ইউনিয়নের অপর বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম জানান, আমি ছিনাই বা বঙ্গসোনাহাট থেকে কোন জন্ম নিবন্ধন তুলিনি। আমি ভোটার কার্ড ব্যবহার করি। কিভাবে বঙ্গসোনাহাটে আমার নামে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু হলো সেটাতো জানা নেই।
এদিকে বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা শ্রী শংকর লাল রবি দাস জানান, প্রায় বছর তিনেক আগে আমার জন্ম নিবন্ধন সনদ তুলেছি এই ইউনিয়ন থেকে। এখন ভোটার আইডিতে বয়সের সমস্যার কারণে আমার জন্ম নিবন্ধন নাম্বার দিয়ে আমার জন্ম নিবন্ধন সনদ তুলতে এসে দেখি আমার নাম নেই। আমার নামের জায়গায় সুলতানা আর ঠিকানা দেখাচ্ছে ছিনাই, রাজারহাট উপজেলার। কয়েকদিন ধরে শুধু ঘুরতেছি। কোন লাভ হয়নি।
এদিকে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের সচিব মকবুল হোসেন জানান, উপজেলা এবং ইউনিয়ন কোড ভিন্ন হলেও জন্ম সনদ ছিনাই ইউনিয়নের প্রিন্টে নিজের এবং চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর দেখে হতবাক এই ইউপি সচিব। তিনি নিজেও জানেন না কিভাবে ঘটেছে এমন ঘটনা।
অপরদিকে ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের সচিব রফিকুল ইসলাম জানান, আমি ২০২০সালে বঙ্গসোনাহাটে ইউনিয়ন সচিব হিসেবে যোগ দেই। এরপর জেলা প্রশাসন থেকে জন্ম-মৃত্যু অনলাইনের পাসওয়ার্ড পাওয়ার পর দেখতে পাই ৭৬ জন নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন তথ্যের অসংগতি। বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যানের নজরে আনায় রোষানলে পরতে হয় আমাকে। ফলে প্রশাসনকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানাই।
এদিকে ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাজান আলী মোল্লার সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫-২০২০ সাল পর্যন্ত সাবেক এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে এমন ঘটনা ঘটলেও তিনি কিছুই জানেন না বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান। এ সময় তিনি পূর্বের সচিবদের উপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায় এড়িয়ে যান। সচিবের মাধ্যমে জানার পর তিনি নিজেও জেলা প্রশাসককে একটি লিখিত অভিযোগ দেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে ভুরুঙ্গামারী উপজেলার নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা সচিবের মাধ্যমে অভিযোগ পাবার কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, এই বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button