লিড নিউজ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারিশ বাস্তবায়নই একমাত্র সমাধান

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে গত চার বছরে একবারও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ না নিয়ে বরং তা এখনও জিইয়ে রেখেছে মিয়ানমার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার যে সুপারিশ করেছিলেন, তার বাস্তবায়নই এই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীনের মধ্যস্ততায় গত ১৯ জানুয়ারি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ত্রিপক্ষীয় সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে চীনের পক্ষে দেশটির ভাইস মিনিস্টার, মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির ডেপুটি মিনিস্টার এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব নেতৃত্ব দেন। এরপর এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আর কোনো বৈঠক করা যায়নি। ঢাকার পক্ষ থেকে দফায় দফায় তাগাদা দিলেও নেপিডো থেকে কোনো জবাব মেলেনি। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের জান্তারা অভ্যুত্থান ঘটানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা-নেপিডো রাজনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
‘মিয়ানমারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যে কেয়ামত পর্যন্ত এই সঙ্কট টিকে থাকবে’Ñ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকার এক কূটনীতিক এ মন্তব্য করেন। তিনি জানান, সঙ্কটের সমাধান করতে গত চার বছরে ঢাকা থেকে কয়েক ধাপে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তথ্য যাচাই-বাছাই করতে নেপিডোকে পাঠানো হয়। বিপরীতে নেপিডো মাত্র ৪১ হাজার ৭১৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করে পাঠিয়েছে ঢাকাকে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমার রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিচ্ছিন্নভাবে যাচাই করে চূড়ান্ত করেছে যাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। যেমন : মিয়ানমার ইচ্ছা করেই একটি রোহিঙ্গা পরিবারের ৫ সদস্যের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করেছে, বাকিদের বিষয়ে কিছু জানায়নি। তারা এমনভাবে যাচাই-বাছাই করে পাঠিয়েছে যাতে পরিবারের একাংশ মিয়ানমারে ফেরত যাবে আর বাকিদের বেলায় অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা কোনো পরিবারই ফেরত যেতে রাজি হবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা এখনই মিয়ানমারে ফিরতে প্রস্তুত নয়।
নেপিডোর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা জন্মাতে এবং প্রত্যাবাসন শুরু করতে রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কথা দিয়েছিল মিয়ানমার। কিন্তু সেখানে তারা কিছুই করেনি। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো মিয়ানমার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে বহুমুখী বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাশাপাশি রাখাইনসহ আশপাশের অঞ্চলে এখনও যেসব রোহিঙ্গা বসবাস করছে তাদের রাখাইন ছাড়তে বিভিন্নভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা হচ্ছে।
সাবেক পররাষ্ট্র মো. সচিব শহীদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার যে সুপারিশ করেছিলেন, তার বাস্তবায়নই এই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান। তিনি আরও বলেন, কয়েক দশক আগে থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করছে এবং উসকানি দিয়ে আসছে মিয়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশ ভদ্রভাবে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সৎভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নেপিডোর কারণে সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সালে মিয়ানমার বাংলাদেশের বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) ৩ সদস্যকে হত্যা করে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে খনিজ আহরণের চেষ্টা চালায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার ১৭ বার বাংলাদেশের আকাশসীমায় অনুমতি না নিয়ে ঢুকেছে এবং ২০১৮ সালে সেন্টমার্টিনকে তাদের বলে মিয়ানমারের মানচিত্রে দেখানোর চেষ্টা করেছে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াই এই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান। এজন্য জাতিসংঘে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার জন্ম নেয় এবং তারা ফিরে যেতে আগ্রহী হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সময়ের আলোকে বলেন, এই সঙ্কট সমাধানে আমরা এখনও আশাবাদী। আমরা মনে করি, মিয়ানমারে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তি, ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং ২০১৮ সালের ১৫-১৬ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী বৈঠকে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত মাঠ পর্যায়ের বিষয় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার এখনও এসব চুক্তির কিছুই মানেনি। মাঝে ২০১৮ সালে চীনের সহায়তায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ এবং বৈঠকও হয়েছে, তাতেও রোহিঙ্গা সঙ্কটের কোনো সমাধান আসেনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কমপক্ষে লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলার অজুহাতে ওই রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে এর পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে আসে আরও সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মানবিক কারণে তাদের দেশের একাধিক শিবিরে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হয়।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button