সারাদেশ

বদলে গেছে আশুড়ার বিল, বাড়ছে শাপলা-পদ্ম আর দেশীয় মাছ

বিলের পানি ধরে রাখার জন্য নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ক্রসড্যাম, পানিতে ছাড়া হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কয়েক হাজার পদ্মের বীজ

বদলে গেছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের আশুড়ার বিল ও শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যানের চিরচেনা রূপ। দেখলে আচমকা মনে প্রশ্ন জাগবে এটি কি সেই আশুড়ার বিল? সেখানে বর্ষা মৌসুমেও কানা ছুঁই ছুঁই পানি ছিল না। ছিল না কোনো পদ্ম বা শাপলা ফুল। স্থানীয় কিছু মানুষের কাছে কচুরীপানা দিয়ে জিম্মি ছিল এই অপার সম্ভাবনাময় বিলটি। জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে বিলে যাওয়ার তেমন রাস্তাও ছিল না। সন্ধ্যা নামলেই রাস্তাগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিণত হয়।

এই বদলে যাওয়ার মূল কারণ মাত্র কয়েক মাস আগে এই জাতীয় উদ্যান ও আশুড়ার বিলকে দৃষ্টিনন্দন করতে বিলের পশ্চিম অংশে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৯০০ ফিট দীর্ঘ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কাঠের সেতু। এর পূর্ব অংশে বিলটির পানি ধরে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ক্রসড্যাম। বিলের পানিতে পর্যটকরা নৌকায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্ত বিলেই ফুটেছে শাপলা আর পদ্ম ফুল। তাছাড়াও বিলে কয়েক হাজার পদ্ম ফুলের বীজ ফেলা হয়েছে। ছাড়া হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে রাস্তাগুলোকে করা হয়েছে প্রশস্ত।লা গানো হয়েছে সোলার সিস্টেম লাইট। বিল সংলগ্ন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেতুতে যেতে রাস্তার দুই ধারে লাগানো হয়েছে বেশ কিছু ওষধি ও ফুলের গাছ। বসানো হয়েছে রকমারি দোকান।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নবাবগঞ্জ শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান। এই জাতীয় উদ্যানটি ২০১০ সালে শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। উদ্যানটি নবাবগঞ্জের ৫১৭.৬১ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থিত।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা সদরের উত্তর-পশ্চিমে জগন্নাথপুর, হরিল্যাখুর, বড় জালালপুর, আলোকধুতি, তর্পনঘাট, রসুলপুর ও খটখটিয়া কৃষ্টপুর মৌজার সুবিশাল শালবনসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে এ উদ্যানের অবস্থান।

জাতীয় উদ্যানের মূল আকর্ষণ পঞ্চবটীর শালবন এবং শালবনের উত্তর পাশ ঘেষে বিশাল আশুড়ার বিল। এ বিলের আয়তন ২৫১.৭৮ হেক্টর। এই বিলের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে বিচিত্র কাহিনী। কথিত আছে, এই বিলের চারপাশ থেকে ৮০টি দার বা নালা চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাওয়ায় এর নামকরণ করা হয় আশুড়ার বিল। এ বিলের সাদা শাপলা ও লাল পদ্মের আধিক্য উপভোগ করার মতো ছিল। শীত মৌসুমে অসংখ্য অতিথি পাখি সমবেত হত। বিলের পাড় থেকে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা বহমান ছিল। বিপুল পরিমাণ দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত।

কিন্তু কালের বিবর্তনে সঠিক রক্ষবেক্ষণের অভাবে ও এক শ্রেণির দখলবাজ মহল বিলটিকে কৃষি জমি হিসেবে ব্যবহার শুরু করলে এর পানি কমে যায় এবং ভরাট হয়ে বিলটি তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। বিলটির পানি কমে মাছের উৎপাদন ও অতিথি পাখির আনাগোনা কমে যায়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মশিউর রহমান এ উপজেলাতে যোগদানের পর স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. শিবলী সাদিকের সহায়তায় বিলটির উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দখলমুক্ত করে পর্যটক আকৃষ্ট করতে নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেতু, রোপন করা হয় সৌন্দর্য বর্ধনকারী বিভিন্ন গাছের চারা, স্থানীয়দের নিয়ে তৈরি করা হয় নিরাপত্তা বলয়। ফলে, সেখানে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার দর্শনার্থীর আনাগোনা শুরু হয়েছে।

এই বিলের আগের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে বিলে পানি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের অর্থায়নে ক্রসড্যাম নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ক্রসড্যাম নির্মাণ শুরু হওয়ায় দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা। এলাকাবাসী মনে করছেন ক্রসড্যামটি নির্মিত হওয়ায় আশুড়ার বিলটি ফিরে পাবে তার আগের সৌন্দর্য। ফলে পর্যটকদের আনাগোনা আরো বৃদ্ধি পাবে। বিলে থাকবে বিপুল পরিমাণ মাছ। যা এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হবে। সৃষ্টি হবে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান।

ওই জাতীয় উদ্যান রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. ছলিমুল্লাহ জানান, ক্রসড্যামটি এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি ছিল। ক্রসড্যামটি নির্মিত হওয়ায় আশুড়ার বিলের চিত্র পাল্টে গেছে। দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা। কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মো. মাহাবুর আলম জানান, ক্রসড্যাম হওয়ায় ইতোমধ্যে বিলে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে  শাপলা ও পদ্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। দেশের বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে বিলটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় উদ্যানটির বিট কর্মকর্তা নিশিকান্ত মালাকার জানান, এ উদ্যানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়াতে আরো নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। উদ্যানটির ভেতরে পশু-পাখিদের খাবারের জন্য ইতোমধ্যে লটকন, বন কাঁঠাল, আমড়া, খুদিজাম, ডুমুর, চাপালিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৭০ হাজার ফলের গাছ লাগানো জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মশিউর রহমান জানান- আশুরার বিলে ক্রসড্যাম নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। বিল পানিতে ভরতে শুরু করেছে। বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। শাপলা পদ্মে ভরে যাচ্ছে এর জলরাশি। মাছ ও পাখির সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণে। ক্রসড্যামে যাবার রাসত্মাটাও প্রায় শেষ। তিনি আশুরার বিলের উন্নয়নে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button