জাতীয়

চামড়াশিল্পকে পরিবেশবান্ধব আধুনিক করতে হবে

ট্যানারি শিল্পে চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। এ চামড়া অন্য সময় সংগৃহীত পশুর চামড়া থেকে উন্নতমানের। প্রতিবছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির পশু থেকে। ফলে এ শিল্পের জন্য উন্নতমানের চামড়া কিনতে ব্যবসায়িরাও এ সময় ব্যস্ত থাকেন। কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তা দিয়েই সারা বছর ট্যানারি শিল্পের কারখানাগুলো চলে। বাংলাদেশে চামড়াশিল্প এগিয়েছে অনেকটা ঢিমেতালে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্পটি কিছুটা গুরুত্ব পেতে থাকে। বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে সরকার প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। স্থানীয় ট্যানারি কারখানাগুলোতে চার ধরনের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে।

 

এর মধ্যে ক্রাশ্ড ও ফিনিশড লেদারই বেশি রপ্তানি হয়। কাঁচা চামড়া নয়, প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে সাধারণত লাভ বেশি হয়ে থাকে। ট্যানারি মালিক, আড়তদার ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। দামের দিক থেকে কাঁচা চামড়া ও ফিনিশ্ড লেদার বা লেদার গুডসের ব্যবধান অনেক। পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পে বিভিন্ন উত্পাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। এখাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের চমত্কার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এর মাধ্যমে। পরিবেশবান্ধব আধুনিক চামড়া শিল্প গড়ে আমাদের অর্থনীতিতে আরো চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুণগত মানের চামড়া, সস্তা মজুরির শ্রমিক ও কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতাসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা জোরদার করতে চামড়া শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রসার ও বিদেশি ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ট্যানারি শিল্পে গুণগত পরিবর্তন আনার জোরালো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

প্রতিবছরই পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো শতশত কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ঋণ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এসব ঋণের বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে । আগেকার কোনো খেলাপি প্রতিষ্ঠান যেন ঋণ না পায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে সতর্ক থাকে ব্যাংকগুলো। ট্যানারি শিল্পের বার্ষিক চামড়ার মোট চাহিদার ৭০-৮০ ভাগই সংগ্রহ করা হয় কোরবানির পশু থেকে । একই সময়ে বিপুল পরিমান চামড়া সরবরাহ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ সময় সব চামড়া নিজেদের নগদ অর্থে কিনতে পারেন না। এ কারণে তারা এসে ধরনা দেন ব্যাংকগুলোতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রনী ও রূপালী ব্যাংকে। চামড়া কিনতে সাধারণত এক বছর মেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়। এ ব্যবসায় জড়িত গ্রাহকরা তা পেয়ে থাকেন। চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের একটা বড় অংশই বছরের পর বছর খেলাপি হয়ে আছে। এসব কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো চামড়া কেনায় ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায়না, যদিও বর্তমানে এখাতে ঋণ আদায়ের হার আগের তুলনায় ভালো। ব্যাংকগুলো সতর্কতার সঙ্গে ঋণ অনুমোদনের ফলে খেলাপির পরিমান আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে ইদানিং।

অনেক দিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের চামড়া শিল্প। পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে কোরবানীকৃত পশুর কাঁচা চামড়া। কয়েক বছর ধরে নামমাত্র মূল্যে কাঁচা চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। তার পরও এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই খেলাপি ঋণের চক্রে আটকা পড়েছেন। এ অবস্থায় এবার পশুর চামড়া কেনার ঋণে গণছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাত্র ৩ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট (এককালীন পরিশোধ) দিয়ে চামড়া খাতের অনাদায়ী ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে তিন বছর। পুনঃতফসিলের পর গ্রাহকের অনুকূলে ২০২০ সালের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের সমপরিমাণ এ বছর বিতরণ করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারীকৃত এক প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক ৬৪৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আগের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় মাত্র ৬৫ কোটি টাকা বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। এ বছরও ব্যাংকগুলো ৫৮৩ কোটি টাকা কাঁচা চামড়ার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ উদ্যোক্তা খেলাপি হওয়ায় ঋণের অর্থ বিতরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। চামড়া শিল্পে বিরাজমান সমস্যাসহ কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাবজনিত কারণে ২০২০ সালে কোরবানীকৃত পশুর কাঁচা চামড়া ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিতরণকৃত ঋণের কিছু অংশ অনাদায়ী রয়েছে। এ কারণে ২০২১ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানীকৃত পশুর চামড়া ক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা প্রদান করা ব্যাংকগুলোর পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েছে।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে আরো মজবুত করতে হলে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমন্বয় গড়ে তোলা, চামড়া সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব নিরসন, চামড়ার রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করা সহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধুমাত্র গার্মেন্টস শিল্পের ওপর ভরসা না করে চামড়া শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের পরিমান আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু না হয়নি। চামড়া খাত নিয়ে একটা রোডম্যাপ করা জরুরি। একই সঙ্গে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button