রংপুর বিভাগসারাদেশ

আমাগো বাড়িতে এহনো পানি, রান্না কইরা পেট ভইরা খাইতেও পারিনা। খুব কষ্টে আছি

আমাগো বাড়িতে এহনো পানি। চুলা জ্বালে রান্না করতে পারিনা ।পেট ভইরা খাইতেও পারি না। বাচ্চাটারে ঠিকমতো খাওয়াইতে পারি না। বাচ্চাটারে নিয়া লাগাতার ভয়ে থাহি।’ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি জীবনের দুর্ভোগের কথা এভাবেই বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুর গ্রামের মঞ্জিলা খাতুন।  মঞ্জিলা-শাহজালাল দম্পতি। জমানো টাকা দিয়ে টিন কিনে নতুন ঘর তুলেছিলেন। বানের পানি ঢুকে তার ঘর এখন যেন চৌবাচ্চা। কোমর পানিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বিছানা দ্বিগুণ উঁচু করেও যেন রেহাই মিলছে না। শিশু সন্তান নিয়ে ওই ঘরেই এক সপ্তাহ ধরে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন। বাঁশের মাচানে চুলা তুলে সেখানেই রান্না করেন। উপকরণের অভাবে তিন বেলা রান্না করা সম্ভব হয় না। এক কিস্তি ত্রাণ সহায়তা পেলেও শিশু সন্তান নিয়ে ঘোলা পানির অসহনীয় বন্দিজীবনে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এদিকে প্লাবিত এলাকায় কাজও জুটছে না। শুধু কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন  নয়।
 জেলার কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী,ফুলবাড়ী, রাজারহাট, উলিপুর, রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলার ৪৮ ইউনিয়নের  বন্যা কবলিত নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপ চরসহ শতাধিক চরের লক্ষাধিক মানুষ বন্যার শুরু থেকে পানিবন্দি রয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের অনেকেই এখনও নৌকা অথবা ঘরের ভেতর মাচাং পেতে  ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে অবর্ণনীয় কষ্টে রয়েছে। বন্যা স্থায়ী হওয়ায় চরে অধিকাংশ বাড়ির বাঁশের খুঁটি ভেঙে ঘর হেলে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এসব বাড়ি ঘর দ্রুত দুমড়ে-মুচড়ে পড়বে বলে ভুক্তভোগীরা আশঙ্কা করছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার,গো-খাদ্য ও শিশু খাদ্যের সংকট তীব্র হয়েছে । জেলা প্রশাসন সরকারি ভাবে ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দের ঘোষণা দিলেও বিতরণে ধীরগতির কারণে অনেক দুর্গম এলাকার মানুষের ভাগ্যে এখনো কোন সাহায্য পৌঁছেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তুলনায় বরাদ্দের পরিমান নগণ্য হওয়ায় সর্বত্র ত্রাণ যাচ্ছেনা না বলেও অভিযোগ  করেছে অনেকে।
এ অবস্থায়  চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি, আশ্রয় কেন্দ্র ও নৌকায় সপ্তাহ খানেক ধরে অবস্থান করা বানভাসি মানুষজন অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হচ্ছে। তাদেরকে এক বেলা খেলে অন্নবেলা উপোশ কাটাতে হচ্ছে ।
কিছু কিছু এলাকায় সরকারী ভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি ভাবেও বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে  প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় তা ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন পাচ্ছেন না বলে একাধিক ভুক্তভোগী দাবি করেছে।
বৃহস্পতিবার উলিপুর উপজেলার বন্যা কবলিত সাহেবের আলগা  ইউনিয়নের চর বাগুয়ায় সকাল  ১০ টার দিকে এ প্রতিবেদক নৌকায় করে পৌঁছুলে ঐ চরের প্রায় ৪০/ ৪৫ টি বাড়ির সবগুলোতেই হাঁটু পানি ও কোমর পানি দেখতে পান । ঐ চরের বাসিন্দা ছলিমুদ্দিন ঘরে মাচাং তৈরি করে পরিবার নিয়ে পানিবন্দি আছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, বন্যায় তাদের সব কিছু ভেসে গেছে। প্রায় সাত দিন বানের পানিতে ভেসে আছে। কাজকর্ম নাই। ঘরে যা খাবার ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে এসে দুই দিন চলল, এখন কি খাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। কেউ কাজেও নিচ্ছে না। সরকারি সাহায্য পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি কোনো লোক এই চরে আসেন নাই। তার মত দুরবস্থার কথা জানালেন, একই  চরের আছর উদ্দিন, ইছুব আলী, রবিয়াল,জায়েদুল, রকিব, মোকসেদ আলী, ছমেদ আলী, রকমত পাগলা, চাঁন মিয়া, শহিদুল, সাইদুল, মাঈদুল ও লাল মিয়া। সবার বাড়িতে কোমর থেকে হাঁটু পানি অবস্থান করছে। একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী কাজিয়ারচর, হকের চর ও সুখের বাতীচরের পানিবন্দি মানুষের।
পানি নেমে না যাওয়ায় এসব পানিবন্দি মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে  দুর্বিষহ জীবন পার করছে। এখানে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট তীব্র ।
 বন্যাকবলিত এ চরের কোথাও সরকারি বা বেসরকারি কোন ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি বলে চরের মানুষজন জানান। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড কমিশনার আবু সাইম একই ধরনের অভিযোগ করেন।  কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সাইদুর রহমান বলেন, বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বানভাসিদের দুর্ভোগ এখনো কমেনি । তিনি আরো বলেন, আমার ইউনিয়নে ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। তবে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো কে বন্যার্তদের পাশে হাত বাড়ানোর জোর দাবি জালান। সদরের ঘোগাদহ ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। ভাঙ্গনে ৬৯ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত  ৯ টি  উপজেলার বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ৩শ ৩৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার শিশু খাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা উপজেলা পর্যায়ে বন্টন করা হয়। তাদের ভাষায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এসব ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে ।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button