বাংলাদেশকে দুষছে মিয়ানমার
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার জন্য বাংলাদেশ টাকা দিচ্ছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও গাম্বিয়া ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ‘প্রক্সি’ হয়ে মামলার আবেদন করেছে। আইসিজেতে কোনো সংস্থার প্রক্সি হয়ে কেউ মামলা করতে পারে না। তাই গাম্বিয়ারও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার নেই।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষের আইনজীবীরা এই যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁরা আদালতে উপস্থাপন করা গাম্বিয়ার আবেদনের পাশাপাশি ওআইসি, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও গাম্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টানেন।
মিয়ানমার গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হয়েও রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ওই সনদ লঙ্ঘন করেছে—এমন অভিযোগ এনে ২০১৯ সালে আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া। ওই বছর শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তারা নতুন করে আইনি দল সাজায়।
আইসিজের বিচারিক ও গাম্বিয়ার এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে মিয়ানমার গতকাল শুনানিতে অংশ নেয়। এবার শুনানির আগে মিয়ানমারের সু চিপন্থী সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্য সরকার (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট—এনইউজি) আইসিজের কাছে আবেদনে বলেছিল, জান্তা নয়, এনইউজে মিয়ানমারের প্রকৃত প্রতিনিধি।
আইসিজে এনইউজের ওই আবেদন আমলে নেয়নি। গতকাল আদালত বসার পরপরই সভাপতিত্বকারী বিচারক বলেন, কোনো সরকার নয়, রাষ্ট্র এই মামলায় প্রতিনিধিত্ব করছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের এজেন্ট হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মন্ত্রী কো কো হ্লাইং। তিনি বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল পরিবর্তন হয়েছে। মিয়ানমার আইসিজের কাছে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করে।
কো কো হ্লাইং বলেন, রাখাইন রাজ্যের ইতিহাস অনেক পুরনো। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সেখানে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি বলেন, মিয়ানমার, চীন ও বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেছে। রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার আলোচনা ও তালিকা যাচাই-বাছাই করছে। রাখাইন রাজ্যে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের শিবিরগুলোতেও কভিড-১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই শিবিরগুলো বন্ধ করা হলে সেগুলোর বাসিন্দারা অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। এর মধ্যেই মিয়ানমারের অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
মিয়ানমারের পক্ষে ক্রিস্টোয়ার স্টকার আদালতের সামনে যুক্তি তুলে ধরেন, গাম্বিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের কোনো বিরোধ নেই। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে গাম্বিয়া আদালতে মামলার আবেদন করেছে। গাম্বিয়া নিজেই মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার প্রমাণ কোথায়? বরং ওআইসির পক্ষে গাম্বিয়া মামলা করেছে, এমন অনেক প্রমাণ আছে। ওআইসির নথি অনুযায়ী, মামলার খরচের জন্য ওআইসি বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। সেখানে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ড। ওই তহবিলের ওপর গাম্বিয়ার নিয়ন্ত্রণ আছে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। তহবিলের বড় অংশ দিয়েছে বাংলাদেশ। ক্রিস্টোয়ার স্টকার বলেন, এ ক্ষেত্রে আইসিজের এখতিয়ারের সীমাবদ্ধতা আছে। আইসিজেতে কেবল রাষ্ট্র মামলার আবেদন করতে পারে। কোনো সংস্থা, এনজিও বা বাণিজ্যিক সহযোগিতা কাঠামো এখানে মামলা করতে পারে না। এই মামলায় রাষ্ট্র হিসেবে গাম্বিয়াকে একটি সংস্থার পক্ষে নামানো হয়েছে। গাম্বিয়া এখানে তৃতীয় পক্ষের প্রক্সি দিচ্ছে।
আইনজীবী স্টিফেন ট্যালমন আদালতে বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার আইনি ভিত্তি গাম্বিয়ার নেই। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার অভিযোগ তুলে গাম্বিয়া আবেদন করেছে। অথচ গাম্বিয়া কোনোভাবেই এখানে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র নয়।
আগামীকাল বুধবার সন্ধ্যায় গাম্বিয়া মামলার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবে। এরপর শুক্রবার রাতে মিয়ানমার ও রবিবার রাতে গাম্বিয়া যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে।
মানবাধিকারকর্মী, সংগঠনগুলোর ক্ষোভ
মিয়ানমারে ব্যাপক নিপীড়নের অভিযোগ ও জান্তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন সত্ত্বেও আইসিজে জান্তার প্রতিনিধিদের মামলায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছেন। এতে ক্ষোভ জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী ও সংগঠনগুলো। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের কো-অর্ডিনেটর মং জার্নি টুইট বার্তায় বলেন, একটি অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়ে আইসিজে বিশ্বের ১৯০টির বেশি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন।
নতুন মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বিশেষ স্থান পাবে : আইসিজের ‘পিস প্যালেসে’ মামলার শুনানির প্রাক্কালে দ্যা হেগে সংবাদ সম্মেলনে এনইউজের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন মার অং বলেন, নতুন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশেষ স্থান পাবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানে হাজার হাজার মৃত্যু হয়েছে। অনেককে নির্বাসিত হতে হয়েছে। তারা বিচারের অপেক্ষায় আছে। তিনি বলেন, জান্তা অস্ত্রের জোরে টিকে আছে।