দুর্যোগসারাদেশ

পলিটেকনিকে ছাত্রলীগ কর্মকাণ্ডের আড়ালে টর্চার সেল, চাঁদাবাজি!

ছাত্রলীগ নামধারী উশৃঙ্খল একদল শিক্ষার্থীর অনৈতিক দাবি পুরণ না করায় রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ উদ্দিন আহম্মদকে হত্যার উদ্দেশ্যে চরথাপ্পর মেরে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যা প্রতিষ্ঠানটির সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এদিকে শনিবারের এই ঘটনার পর বিস্তর অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

রাজশাহী পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ভর্তি ও বদলি বাণিজ্য, ছাত্র কল্যাণ তহবিলে হস্তক্ষেপসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা।

রবিবার (৩ নভেম্বর) সকাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফেটে পড়ে। এসময় তারা রাস্তায় নেমে আসে এবং পলিটেকনিক এলকায় থাকা ছাত্রলীগের সকল ব্যনার ও পোস্টার সরিয়ে ফেলে। আন্দোলন চলে দিনভর। এসময় রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের বিভিন্ন বিভাগের প্রধান, একাধিক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী এই ছাত্রলীগ কমিটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও অপরাধের প্রমাণসহ অভিযোগ তুলে ধরে।

এদিকে শনিবার অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন ছাত্রলীগের এই কমিটির এমন আচরণ প্রথম নয়। ছাত্র কমনরুমের পাশে ১১১৯ নম্বর রুমটি ছাত্রলীগ টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। ছাত্রলীগের কথার অবাধ্য হলেই শিক্ষার্থীদের এই কক্ষে সুকৌশলে ডেকে নিয়ে এসে চালানো হতো নির্যাতন। শনিবার রাতে ওই কক্ষ থেকে নির্যাতনের বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছে কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে রয়েছে রড, স্ট্যাম্প, ব্যাট। এছাড়া সেখান থেকে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হয়। এছাড়া সেই পুকুরে নিয়মিত কোনো না কোনো শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিং এর নামে ফেলে দেয়া হতো।

পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিগেন ও সহ সভাপতি আবু সাইদ খান অন্তুর নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করতে সবসময় উন্মুখ হয়ে ছিল। তারা দল ভারি করতে প্রতিষ্ঠানটির অকৃতকার্য ও অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাজে লাগাতে শুরু করে। অকৃতকার্য ও অনিয়মিত শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়া না করেই পাশের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগের এই কমিটিকে নিরাপদ আশ্রয় করে নেয়।

নকল করতে নিষেধ করলে শিক্ষকদের তেড়ে মারতে যাওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ইংরেজী বিষয়ের (ননটেক) শিক্ষক মো. নুরুল্লাহকে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নামধারী এই নেতারা চেয়ার তুলে মারতে তেড়ে গেছেন। কারণ হিসেবে জানা গেছে, পরীক্ষার হলে এই শিক্ষক নকল করতে না দিলে ছাত্রলীগের নামধারী এসব শিক্ষার্থীরা এভাবে মারমুখি আচরণ করেন। তাপশ কুমার নামের অপর এক শিক্ষককেও একই কারণে বিভিন্ন সময় নির্যাতন করা হয়েছে।

সম্প্রতি ৫৫০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৩৩ জন শিক্ষার্থী ফেল করলে, সেই সকল শিক্ষার্থীদের সংঘবদ্ধ করে মহানগর আওয়ামী লীগে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয় শিক্ষার্থীদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেল করানো হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী পলিটেকনিকের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বললে, তারা নওশের আলীকে পলিটেকনিকে আমন্ত্রণ জানান। পরে তিনি পলিটেকনিকে অধ্যক্ষের সাথে দেখা করতে আসলে তাকে সেই ফেল করা শিক্ষার্থীদের খাতাগুলো সৌজন্যের খাতিরে দেখানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে নওশের আলী বলেন, আমি খাতাগুলো দেখেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা ওই খাতাগুলোতে নম্বর দেয়ার মতো লেখেনি। তাই ফেলকরা ওই শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এদিকে এই পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের কমিটি নবীনবরণের নামে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোর পূর্বক তিনশ টাকা করে চাঁদা তুলেছে। বিষয়টি জানানোর পর প্রতিষ্ঠানটির হস্তক্ষেপে সাড়ে চার লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানটির কোশাগারে নিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বাকি প্রায় চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ছাত্রলীগের এই কমিটি তুলে নিয়েছে। এদিকে এই তিনশ টাকা তোলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। এমনকি কোন ছাত্র পলিটেকনিক ট্রান্সফার বা বদলি করে রাজশাহী পলিটেকনিকে আসলে সেই শিক্ষার্থীকে ভয় ভীতি দেখিয়ে তার কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকা আদায় করা হতো। আর কাঙ্খিত চাঁদা না দিলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসত অমানবিক নির্যাতন। এজন্য তারা ছাত্রলীগের নির্যাতন সেল হিসেবে পরিচিত ১১১৯ নং কক্ষ, পুকুর ও টেনিসগ্রাউন্ড ব্যবহার করে। এছাড়া ক্যাম্পাসের ছাত্রদের কাছ থেকে মোবাইল ও ল্যপটপ ছিন্তাই এর ঘটনা নতুন কিছু না। এমনকি মিছিলের নামে বিভিন্ন সময় ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হতো। আর মিছিলে যেতে অস্বীকার করলে সেই শিক্ষার্থীকে নেয়া হতো টর্চার সেলে।

এছাড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেই দিতে হতো চাঁদা! বিভিন্ন দিবসে প্রতিষ্ঠান কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করলে ছাত্রলীগের এই কমিটি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতো। এই দাবির পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। আর চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার ভয় দেখান হতো।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের করা এসকল অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বাংলাদেশের সরকারি ৪৯টি পলিটেকনিকের মধ্যে রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ৪৫ তম অবস্থানে রয়েছে। বিভাগীয় শহরে এই পলিটেকনিকে হওয়ার পরও আমাদের এই অবস্থান নিয়ে আমরা চিন্তিত। তাই আমরা এই পলিটেকনিকে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। এর জন্য শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ওপর জোড় দিতে বলা হচ্ছে। এক জন শিক্ষার্থী খাতায় না লিখেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে যাবে। এমন মেধাহীন ইঞ্জিনিয়ার আমরা দেশকে দিতে চাই না। আর তাই অনিয়ম বন্ধ করায় ছাত্রলীগ নামধারীরা এই শিক্ষাঙ্গনকে উত্তপ্ত করে চলেছে।

এদিকে অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব ও পরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত ওই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব ও পরিচালাক (পিআইডব্লিউ) এসএম ফেরদৌস আলমকে। বাকি দুই সদস্যরা হলেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালাক (কারিকুলাম) ড. মো. নুরুল ইসলাম এবং রাজশাহী মহিলা পলিকেনিটক ইনিস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওমর ফারুক।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এসএম ফেরদৌস আলম বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সাথে সাথে তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আমরা ঘটনার এক দিন পরেই এখানে এসেছি। ভিডিও ফুটেজ দেখেছি। তদন্ত শেষ করে দোষীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তের আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন আহম্মদের উপর হামলার ঘটনায় চন্দ্রিমা থানায় আট জনের নামসহ ৫০ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর পর ২৫ জন সন্দেহ ভাজনকে শনিবার রাতে আটক করে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচ জনকে ভিডিও ফুটেজ দেখে সনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি দের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার কাউনিয়া পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে সোহেল রানা (২০), নড়াইলের বাগাদিপাড়া থানাধীন কালাবাড়ীয়া গ্রামের ফরিদ আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম আরিফ (২০), নীলফামারীর ধোপাডাঙ্গা গ্রামের গোপাল রায়ের ছেলে বাঁধন রায় (১৯), নওগাঁর মান্দা থানার কাসোবা খাজুরিয়া পাড়া গ্রামরে মৃত আফসার আলীর ছেলে সাফি শাহারিয়ার (২৪) ও নগরীর চন্দ্রিমা থানাধীন আসামকলোনী এলাকার রেজাইল করিমের ছেলে রিপন আলী (২০)।

এদিকে রাজশাহী পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের সকল কার্মকাণ্ড স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বহিস্কার করা হয়েছে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৌরভকে। এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগ।

 

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button