জাতীয়

ঢাকার বায়ু সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি দূষিত

ঢাকা শহরের বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। এই শহরের মধ্যে আবার এলাকাভেদে দূষণের রকমফের আছে। অর্থাৎ কোথাও দূষণ অনেক বেশি, কোথাও কম। চার বছর ধরে সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে ফার্মগেটকে হটিয়ে ওই স্থান দখল করে নিয়েছে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা। আর ফার্মগেট নেমে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। এরপরেই যথাক্রমে দূষণের শীর্ষ সারিতে রয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডির শংকর, নয়াপল্টন ও হাজারীবাগ এলাকা।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ৭০টি স্থানের বায়ু চারবার পর্যবেক্ষণ করে এ তথ্য পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শব্দ ও বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণের জন্য ওই ৭০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই একই স্থানে এয়ার ভিজ্যুয়ালসহ মোট চারটি সংস্থার বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বায়ুর ওই মান মাপা হয়েছে। মূলত বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-১, পিএম-২.৫ ও পিএম-১০–এর পরিমাণ পরিমাপ করে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মানমাত্রা ধরে দূষণের এই হিসাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাপস-এর পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “এত দিন আমরা মনে করতাম, ইটভাটা হচ্ছে ঢাকার বায়ুদূষণের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ উৎস। কিন্তু বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে এখন মনে হচ্ছে, রাজধানীতে বিপুল পরিমাণে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও সীমান্ত পেরিয়ে আসা দূষিত বায়ু ঢাকা শহরের বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে।”

ক্যাপস-এর পর্যবেক্ষণে ঢাকা শহরের দূষণের উৎস সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা দেয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এত দিন বলা হতো, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা। এরপরেই পর্যায়ক্রমে নির্মাণকাজের ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও শিল্পকারখানা থেকে বের হওয়া দূষিত বায়ুর ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু নতুন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫–এর পরিমাণ বেশি। এটি সাধারণ জীবাশ্ম পোড়ানো জ্বালানি থেকে আসে। অর্থাৎ যানবাহন, শিল্পকারখানা ও জৈব বস্তু পোড়ালে যে ধোঁয়া বের হয়, তা থেকে আসে।”

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণ গবেষক আবদুস সালাম বলেন, “ইটভাটাগুলো শুধু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১০০ দিন চালু থাকে। কিন্তু ঢাকার বায়ু বছরে ৩০০ দিন খারাপ বা অস্বাস্থ্যকর থেকে খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে, যানবাহনের ধোঁয়াসহ অন্য উৎসগুলোও দূষণে অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে।”

ক্যাপস-এর গবেষণায় ঢাকা শহরের জনবিন্যাস ও ভূমির ব্যবহারের দিক থেকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, সংবেদনশীল এলাকা, মানে যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও হাসপাতাল রয়েছে। এমন ২০টি এলাকায় বাতাসের মান যা থাকা উচিত, তার চেয়ে সাড়ে চার গুণ বেশি দূষণকারী পদার্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার বাতাসে পিএম-২.৫ এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৪ মাইক্রোগ্রাম। এরপর যথাক্রমে রয়েছে ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ে ৩৬৬ মাইক্রোগ্রাম, সচিবালয়ে ৩৫০ মাইক্রোগ্রাম। তুলনামূলকভাবে বায়ুর মান ভালো পাওয়া গেছে শাহবাগ ও উত্তরা এলাকায়।

২০টি আবাসিক এলাকার বায়ুতেও সাড়ে ৪ গুণ বেশি দূষণকারী সূক্ষ্ম বস্তুকণা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পুরান ঢাকার লালবাগের শ্রীনাথ স্ট্রিটের বায়ু। সেখানে বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণা পাওয়া গেছে ৫০৭ মাইক্রোগ্রাম। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে ফার্মগেটের কাছে মণিপুরিপাড়া, যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের বাতাস। তুলনামূলকভাবে বায়ুর মান ভালো পাওয়া গেছে ঢাকা সেনানিবাস–সংলগ্ন মানিকদী ও গুলশান এলাকায়।

বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে রামপুরার উলন এলাকার বায়ুতে পাওয়া গেছে ৪৪৯ মাইক্রোগ্রাম। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে পুরান ঢাকার ইসলামপুর, পল্টন। তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলামোটর ও উত্তরার জসীমউদ্‌দীন রোডের বায়ুর মান। তবে সামগ্রিকভাবে ১৫টি বাণিজ্যিক এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ৭ গুণ বেশি সূক্ষ্ম বস্তুকণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

২০টি মিশ্র এলাকার মধ্যে ফার্মগেট পুলিশ ফাঁড়ির সামনে সবচেয়ে বেশি দূষিত সূক্ষ্ম বস্তুকণা (প্রতি ঘন মিটারে ৩৬৯ মাইক্রোগ্রাম) পাওয়া গেছে। এরপরেই রয়েছে বংশাল ও নয়াপল্টন এলাকায়। তুলনামূলক বায়ুর মান পাওয়া গেছে নিউমার্কেট ও বড় মগবাজার এলাকায়। পাঁচটি শিল্প এলাকার বায়ুর মান স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণের বেশি দূষিত সূক্ষ্ম বস্তুকণা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড় এলাকায়, ৪৩৬ মাইক্রোগ্রাম।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আলোকে বলেন, “রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎস এবং এর প্রতিকার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরাও বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটার চেয়ে অন্যান্য উৎসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, ইটভাটা বন্ধ করার পরও দূষণ কমেনি।”

তা ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে প্রতি রাতে হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহন এই শহরে ঢুকছে। এগুলোর চাকার সঙ্গে প্রচুর বালু ও মাটি আসে। সেগুলো বাতাসে মিশে গিয়েও দূষণ বাড়াচ্ছে। এসব উৎস কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়েও কাজ চলছে বলে জানান রফিক আহমেদ।

বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শনিবার বেশির ভাগ সময় রাজধানীর বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, যা বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থান। দিনভর শীর্ষে ছিল ভিয়েতনামের হ্যানয় শহর। আর তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে ভারতের কলকাতা ও পাকিস্তানের লাহোর শহর।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button