জাতীয়লিড নিউজ

শুদ্ধি অভিযানের মাঝেও সড়কে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি!

শুদ্ধি অভিযানের মাঝেও বেপরোয়া পরিবহন চাঁদাবাজরা। টার্মিনালভিত্তিক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে অর্থ আদায়। এরা সবাই এক সুতোয় বাঁধা। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা।

মাসে নগরীর ৪ টার্মিনাল, বিভিন্ন পয়েন্ট ও সড়ক থেকে আদায় হচ্ছে ৬০ কোটি টাকা। প্রতিদিন আদায় হচ্ছে দুই কোটি টাকা।

গণপরিবহন, অবৈধ লেগুনা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এ অর্থ। এর ভাগ যাচ্ছে অনেক দূর।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে গাড়ির চাকা ঘুরলেই গুনতে হয় চাঁদা। মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক এই সিন্ডিকেট। এ চক্রের হাতে জিম্মি ২০ লক্ষাধিক পরিবহন শ্রমিক।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি বলেন, সড়কে এখন কোনো চাঁদাবাজি হচ্ছে না। যদি কেউ চাঁদাবাজি করে থাকে তবে যারা কোম্পানি করেছে তারা হয়তো করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।

তিনি বলেন, অন্যান্য যেসব খাতে চাঁদাবাজি হচ্ছে সেগুলো তো আর আমি বলতে পারি না।

বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব আলী রেজা বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা কোম্পানি খুলে জিপির (গেট পাস) নামে হরিলুট চালাচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে কোম্পানি সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।

এ ছাড়া বন্ধ হবে না। ব্যাঙের ছাতার মতো শ্রমিক সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন না দিয়ে সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণেরও আহ্বান জানান তিনি।

গণপরিবহনের চাঁদাবাজি নিয়ে চলছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আগে একজনের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট পরিচালিত হতো। কিন্তু শুদ্ধি অভিযানে নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর কে চাঁদার টাকা নেবেন তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।

দ্বিতীয় সারির নেতারা নিজস্ব বাহিনী নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন টার্মিনালগুলোতে। এ অবস্থায় প্রভাবশালী অনেককেই টাকা দিতে হচ্ছে। এনিয়ে একপক্ষ দোষারোপ করছে আরেক পক্ষকে।

অন্যদিকে পুলিশের নামেও পরিবহন থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কে লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকেও তোলা হচ্ছে চাঁদা।

ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা পরিবহনের সিস্টেমকে ডিজিটাল করার চেষ্টা করছি। টিকিট সিস্টেম, কল্যাণ ফান্ডের জন্য কেউ চাঁদা নিলে ব্যাংকের মাধ্যমে নেবে। আমরা মালিক শ্রমিক ও আমাদের লোকজন নিয়ে বসব। সিস্টেম ডেভেলপ করলে আমার মনে হয় এসব অনিয়ম অটোমেটিক বন্ধ বা কমে যাবে। তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।

জানা গেছে, গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে ৩৪টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৮৮টি বাস বিভিন্ন রোডে চলাচল করে। সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে চলাচল করে সাড়ে তিন হাজার গাড়ি। একইভাবে মহাখালী থেকে আড়াই হাজার, গুলিস্তান থেকে ১২০০, মিরপুর থেকে ৭০০, আজিমপুর থেকে ৫০০, মতিঝিল কমলাপুরে ৪০০, গাবতলী টার্মিনালে ৩ হাজার ২০০, ভাসমান আরও ১ হাজার ৩০০ গাড়ি চলাচল করে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার গাড়ি (গণপরিবহন) চলাচল করে নগরীর বিভিন্ন রোডে।

প্রতিটি গাড়ি থেকে জিপি (গেট পাস) দিনে আদায় করা হয় গড়ে ১ হাজার ১০০ টাকা করে। এ খাতে প্রতিদিন মোট আদায় হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বেশি। শুধু জিপি থেকেই মাসে আদায় ৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এ ছাড়া মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, হরতাল ভাংচুর ভর্তুকি, ইফতার, অফিস ক্রয়, কমিউনিটি পুলিশ, বোবা ফান্ড (কমন ফান্ড) সুপারভাইজার, কাঙালি, লাঠি বাহিনীর নামে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হচ্ছে। মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে গণপরিবহন থেকেই মাসে আদায় ৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া লেগুনা, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে জোর করে টাকা আদায় হচ্ছে।

গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে ৩৪টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৮৮টি বাস বিভিন্ন রোডে চলাচল করে। বাসগুলো থেকে গড়ে ১ হাজার ১০০ টাকা হিসাবে জিপি (গেট পাস) আদায় করা হয় দিনে ১৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়া শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৩০ টাকা হারে আদায় হয় দিনে ৫১ হাজার টাকা, মাসে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের নামে আদায় হয় দিনে ৮৫ হাজার টাকা। মাসে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

মালিক সমিতির নামে মাসে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ টাকা, ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৪০ লাখ ৫১ হাজার ২০০ টাকা, হরতাল ভাংচুর ভর্তুকির নামে ১০ লাখ ১২ হাজার ৮০০ টাকা, অফিস ক্রয়ের নামে ১০ লাখ ১২ হাজার ৮০০ টাকা, কমিউনিটি পুলিশের নামে ১০ লাখ ১২ হাজার ৮০০ টাকা, কমন ফান্ড বা বোবা ফান্ডের নামে ১ কোটি ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা, সুপারভাইজারদের খাতে আদায় হয় ৩০ লাখ ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। সব মিলিয়ে ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল থেকেই আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ ২৪ হাজার ২০০ টাকা।

একইভাবে টাকা আদায় হয় গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী টার্মিনাল ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে। সায়েদাবাদ টার্মিনালে গাড়িচালক বাবুল মিয়া জানিয়েছেন, টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের করার আগেই গুনতে হয় জিপির টাকা। তিনি জানান, ৮০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জিপি আদায় করা হয় বিভিন্ন পরিবহনে।

সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগের সদস্য সচিব ইসমাইল হোসেন বাচ্চু বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বে সড়ক ও টার্মিনালে চাঁদাবাজি হচ্ছে।

বাচ্চুর অভিযোগ- প্রতিটা টার্মিনালেই রয়েছে খোন্দকার এনায়েত উল্লাহর নিজস্ব লোক। তারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে।

টুপি বাবুলসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা সবাই খোন্দকার এনায়েত উল্লাহর লোক।

টুপি বাবুল বলেন, তিনি এয়ারপোর্ট মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। খোন্দকার এনায়েত উল্লাহর লোক বলে তিনি শিকার করেন। বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, বাচ্চু যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, এরা আমার লোক হবে কেন? তাদের প্রত্যেকের একটা পরিচয় আছে।

তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ফুলবাড়িয়ার শ্রমিক নেতা ছিলেন ইসমাইল হোসেন বাচ্চু। চাঁদাবাজির কারণে তাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। তিনি আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন।

এনায়েত উল্লাহ বলেন, সড়কে চাঁদাবাজি বলতে কোম্পানির নামে যে জিপি আদায় করা হয় তা মারাত্মক। প্রতিটা বাস থেকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হয়। আমরা এটা বন্ধের চেষ্টা করছি।

এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, গুলিস্তান থেকে আবদুল্লাহপুর রোডের এক গাড়ির চালক গুলিস্তানে যাত্রার শুরুতেই ১ হাজার ২৮০ টাকা জিপি দিচ্ছেন।

এই চালক বলেন, ট্রিপ নিয়ে যাওয়া এবং আসার পথেও এভাবেই চাঁদা দিতে হয়। গুলিস্তানের পর প্রেস ক্লাবের সামনে ১০ টাকা, শাহবাগে ১০ টাকা, ফার্মগেটে ৪০ টাকা, মহাখালীতে ১০ টাকা, বনানীতে ১০ টাকা, শ্যাওড়ায় ১০ টাকা, খিলক্ষেতে ১০ টাকা, আবদুল্লাহপুরে ৪০ টাকা চাঁদা দিতে দেখা যায়।

তার দাবি- এসব চাঁদার টাকা খোন্দকার এনায়েত উল্লাহসহ রাঘববোয়ালদের পকেটে যায়।

তিনি বলেন, মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজির কারণে গাড়ির মালিক ও শ্রমিকদের পথে বসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

তিনি বলেন, চাঁদা পরিশোধ এবং মালিককে পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার পর নিজেদের কাছে আর কিছুই থাকে না।

এদিকে শুধু বাস-মিনিবাস নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চলাচলকারী টেম্পো, অটোটেম্পো, লেগুনা এমনকি ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা থেকেও প্রতিদিন চাঁদা তোলা হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা ও পুলিশের নামে এসব অবৈধ যান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। প্রায় ৭০০ লেগুনা চলে রাজধানীর ১২টি রুটে।

এ ছাড়া উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁওসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধভাবে চলাচল করছে।

লেগুনাগুলো দৈনিক ১ হাজার ৫০০ টাকা জমা বা ভাড়া আদায়ের ৩০ শতাংশ কমিশন দিয়ে চলে। গ্যাস, সহকারীর খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, তা-ই চালক নেন। এসব খরচ বাদেও প্রতিদিন চালককে গুনতে হয় ‘লাইন খরচের’ টাকা। রুটভেদে দিনে গাড়িপ্রতি দেড়শ’ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেন তারা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বিভিন্ন নেতার পরিচয়ে চাঁদাবাজি হয়।

মোহাম্মদপুর এলাকায় কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিবের সহযোগীদের বিরুদ্ধে রয়েছে লেগুনা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ। রাজিবের অন্যতম সহযোগী সিএনজি কামাল হাজারীবাগের সেকশন থেকে গাবতলীগামী ১২০টি লেগুনা থেকে ১৫০ টাকা করে প্রতিদিন ১৮ হাজার টাকা আদায় করত।

এ ছাড়া মোহাম্মদপুর থেকে গুলশান রুটে ৮০টি লেগুনা, ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, কৃষি মার্কেট, বড়বাগ রুটে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের প্রায় ২০০ লেগুনায় চাঁদা আদায় করত রাজিবের সহযোগীরা।

রাজিব গ্রেফতার হওয়ার পর এদের কেউ কেউ গা ঢাকা দিলে তারা তাদের সহযোগীদের দিয়ে চাঁদা আদায় করছে। মিরপুর-২ থেকে ৬০ ফুট রোডে রেডিও মোড় পর্যন্ত চলাচল করে ১০০টি লেগুনা।

লেগুনাচালক ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ রুটের প্রতিটি লেগুনা থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা নেয় মাসুদ রানা নামে এক যুবক। সে স্থানীয় বিভিন্ন নেতার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকেও বেশুমার চাঁদাবাজি চলছে। মোহাম্মদপুর থেকে হাজারীবাগের সেকশন রোডে ১৬০টি অটোবাইক থেকে প্রতিদিন ২৪ হাজার টাকা উঠে রাজিবের সহযোগী সিএনজি কামালের নামে।

রাজিবের বড় ভাই রাসেলের নামে মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকা উদ্যানগামী অটোবাইক থেকে ১০ হাজার টাকা তোলা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর-বছিলা রোডে রাজিবের সহযোগী অভি ফারুক ২০টি অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন ৬০ হাজার টাকা তুলত। রাজিবের সহযোগীরা গা ঢাকা দিলেও তাদের সহযোগীরা এখন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।

এভাবে নগরীর প্রতিটি এলাকায় প্রভাবশালী ও তাদের সহযোগীদের ছত্রছায়ায় চলছে চাঁদাবাজি। পল্লবী এলাকায় চলাচলরত অবৈধ অটোরিকশা থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম বাপ্পী ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাপ্পী বলেছেন, আমি এসবে জড়িত নই। আমি একাধিকবার অটোরিকশা ডাম্পিং করিয়েছি। একবার ১০০-র বেশি রিকশার ব্যাটারি খুলেও রাখি। চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button