শিক্ষাঙ্গন

আবরার স্কুলের মাঠেই মারা গিয়েছিল : ডা. আশিস

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার স্কুলের মাঠেই মারা গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশিস কুমার চক্রবর্তী।

রবিবার (৩ নভেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করে ইউনিভার্সেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, স্কুলের মাঠেই আবরার মারা যায়। তার সঙ্গে কিশোর আলোর দুজন স্বেচ্ছাসেবীও ছিল। তাকে মেডিকেল ক্যাম্পেই চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেছিলেন। সেখানে কিশোর আলোর যে স্বেচ্ছাসেবীরা ছিলেন, তারা তা জানতো। তাদের হাতে ওয়াকিটকি ছিল। তখন তারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছিল কিনা, তা আমরা জানি না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের একজন চিকিৎসক মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ফোন দিয়ে জানান কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে। তবে একজনকে মৃত ঘোষণা করতে হলে কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। সেগুলো সম্পন্ন করতেই সেখানে থাকা দুজন চিকিৎসক তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

ডা. আশিস বলেন, পরে হাসপাতালে পৌঁছলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তার হার্টবিট পাচ্ছিল না, পালস পাচ্ছিল না। তারপরও সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন চিকিৎসকরা। বিকাল ৪টা ৫১ মিনিটে ছেলেটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তিনি জানান,‘পরে গীতিকার কবীর বকুল আমাকে ফোন দেন। আমি তাকে বিষয়টি জানাই। এরপর প্রথম আলোর আনিসুল হকের সঙ্গেও আমার কথা হয়। তারা সাড়ে ৬টার দিকে ছেলেটিকে দেখতে হাসপাতালে আসেন।’

নিকটস্থ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে না নিয়ে তাকে কেন মহাখালী নেওয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আশিস বলেন, ‘সেখানে চিকিৎসকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল।’

উল্লেখ্য, শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকাল তিনটার দিকে রাজধানীর রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কিশোর আলোর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন ওই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার (১৫)। পরে তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আবরার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির দিবা শাখার শিক্ষার্থী ও আবাসিক ছাত্র ছিল। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া আবরারের বাবা সৌদি আরব থাকতেন। তারা দুই ভাই। বড়ভাই প্রকৌশলী, তিনি জার্মানিতে থাকেন।

জানা গেছে, শুক্রবার বিকালে কলেজ ক্যাম্পাসে কিশোর আলো আয়োজিত ‘লাভেলো কিআনন্দ’ অনুষ্ঠানে অংশ নেয় আবরার। অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চের পেছনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সে গুরুতর আহত হয়। পরে আয়োজকরা তাকে উদ্ধার করে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়না তদন্ত ছাড়াই নিহতের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। রাতেই জানাজা শেষে তার মরদেহ নোয়াখালী নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এ দিকে আবরারের মৃত্যুর বিষয়টি কিশোর আলো কর্তৃপক্ষ ও কলেজের পক্ষ থেকে না জানানোর কারণে গোপন থাকে। পরে সহপাঠীদের বিক্ষোভ ও ফেসবুকে পোস্টের কারণে বিষয়টি সামনে আসে। আবরারের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরেও অনুষ্ঠানটি চলতে থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

এ ঘটনায় কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেন, রেসিডেনসিয়ালের ছাত্র আবরার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর নিকটস্থ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে না নিয়ে কেনো মহাখালীর আয়েশা হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘কিশোর আলো কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতায় এবং মাঠে বিরাজমান আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের ‘এফসিপিএস’ ডাক্তারদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তাকে নিকটস্থ ‘সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের’ জরুরি বিভাগে না নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে মহাখালীস্থ ‘আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে’ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ আয়েশা মেমোরিয়াল এই সংক্রান্ত ব্যাপার ‘ফ্রি’ তে করার জন্য চুক্তিবদ্ধ। বলে রাখা ভালো, আবরার তখনো জীবিত এবং অনুষ্ঠান চলমান।’

অন্য দিকে নাইমুরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। রাত ১টা ৩৫ মিনিটে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়ে কিশোর আলোর সম্পাদক লিখেছেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, কিশোর আলোর অনুষ্ঠান দেখতে এসে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজের ক্লাস নাইনের ছাত্র নাইমুল আবরার বিদ্যুতায়িত হয়। ওখানেই জরুরি মেডিকেল ক্যাম্পে তাকে নেওয়া হয়। দুজন এফসিপিএস ডাক্তার দেখেন। জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে বলেন। হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

আনিসুল হক আরও লিখেছেন, ‘আমার জীবনে এর চেয়ে মর্মান্তিক খবর আমি আর পাই নাই। আমি এখন হাসপাতালে আছি। প্রিন্সিপাল স্যার আছেন। নাইমুল আবরারের বাবা-মা এবং আত্মীয়রা আছেন। আমি ও কিশোর আলো আজীবন আবরারের পরিবারের সঙ্গে থাকব। যদিও এই অপূরণীয় ক্ষতি কিছুতেই পূরণ হবে না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছি। নাইমুল আবরারের জন্য দোয়া করছি।’

ফেসবুকে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল হক দাবি করেন, ‘এখন ফেসবুকে কতগুলো প্রচারণা দেখছি। আমি আমার জানা দেখা কথাগুলো বলি। আমাকে ৪টার পর জানানো হয়, একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। আরও খানিক পরে জানানো হয়, আহত ভদ্রলোক সম্ভবত চট্টগ্রাম থেকে আসা। অনুষ্ঠান শেষ হয় ৪টা ৪০ কি ৪টা ৪৫। পাঁচটার পর আমি জানতে পারি, আহত জন মারা গেছেন। মানে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ১৫/২০ মিনিট পরে মৃত্যুর খবর আমি পাই। তারও আধ ঘণ্টা পর আমাকে জানানো হয়, যিনি মারা গেছেন, তিনি ক্লাস নাইনের ছাত্র রেসিডেনসিয়ালের ছাত্র।’

তিনি বলেন, ‘কাজেই যারা বলছেন, নাইমুল আবরার মারা যাওয়ার খবর গোপন করে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা ঠিক বলছেন না। শেষ শিল্পী অর্ণব মঞ্চে ওঠার আগে দুর্ঘটনা সম্ভবত ঘটেনি। সম্ভবত বলছি, কারণ একেকজন একেকটা কথা বলছেন।’

আনিসুল হক আরও দাবি করেন, ‘দ্বিতীয়ত, ইউনিভার্সেল হাসপাতাল আমাদের স্পন্সর নয়। তারা আমাদের জরুরি মেডিকেল সার্ভিস দেওয়ার জন্য ওখানে ছিলেন। দুজন এফসিপিএস ডাক্তার ছিলেন। একটা অ্যাম্বুলেন্স রেডি ছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সেই নাইমুল আবরারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কেন তাকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেওয়া হলো না, এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আমরা যে মেডিকেল ক্যাম্প, টিম, অ্যাম্বুলেন্স রেডি রেখেছিলাম, সেটা ভালোর জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা থাকা সত্ত্বেও নাইমুল আবরার আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

অপর দিকে আনিসুল হকের স্ট্যাটাসের ঘণ্টাখানেক পর কিশোর আলোর ফেসবুক পেজে আবরারের মৃত্যুর বিষয়ে আরেকটি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। ওই স্ট্যাটাসে বলা হয়েছে, আবরারের মৃত্যুর কারণে শনিবারের পর্যালোচনা সভাসহ কিআনন্দ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি সভা ও কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে।

এ দিকে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আবরারের মৃত্যুর জন্য অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের অবহেলাকে দায়ী করেছে শিক্ষার্থীরা।

শনিবার (২ নভেম্বর) সকালে রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে তারা চার দফা দাবিও জানিয়েছেন। পরে কলেজের অধ্যক্ষ এসে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে আশ্বস্ত করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শান্ত হন।

তাদের চার দফা দাবিগুলো হলো- ঘটনা চলাকালীন সিসিটিভি ফুটেজ শিক্ষার্থীদের হাতে দিতে হবে, অনুষ্ঠানের অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে কিশোর আলো কর্তৃপক্ষকে লিখিত স্টেটমেন্ট দিতে হবে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ছাত্রদের হাতে দিতে হবে এবং শুধু দুর্ঘটনা নয় তাদের গাফিলতি, মিস ম্যানেজমেন্ট এবং উদাসীনতা উল্লেখ করে পত্রিকায় স্টেটমেন্ট দিতে হবে।

কলেজটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম আহমেদ বলেন, নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া এই ঘটনায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। রবিবার (৩ নভেম্বর) কলেজটির সাবেক ছাত্র ওবায়েদ আহমেদের পক্ষে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাইজুল্লাহ ফয়েজ।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button